🔹 পটভূমি ও প্রেক্ষাপট

১৯২৭ সালে ভারতের মেওয়াত অঞ্চলে তাবলীগ জামাতের প্রতিষ্ঠা করেন মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস কান্ধলভী (রহঃ)। তাবলীগ জামাত আজ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ইসলামী দাওয়াতি আন্দোলনগুলোর একটি। তবে এই মেহনতের শুরুটা খুব সহজ ছিল না। মেওয়াত অঞ্চলের মুসলমানদের ধর্মীয় শিক্ষা ও চেতনা ছিল খুবই দুর্বল, তারা ইসলামি জীবনাচার থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছিল।

মেওয়াত ছিল এমন একটি অঞ্চল যেখানে মেও (Meo) সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করতো। এরা মুসলিম নামধারী হলেও, তাদের দৈনন্দিন জীবন ছিল হিন্দু সংস্কৃতির সাথে মিশ্রিত। তাদের মধ্যে ইসলামি আচার-আচরণ, নামাজ, রোজা, হালাল-হারাম বোধ প্রায় হারিয়ে যাচ্ছিল। বিয়ের সময় হিন্দুদের মত গান-বাজনা, পূজা-পার্বণে অংশগ্রহণ করা ছিল খুবই সাধারণ বিষয়। এইসব বিষয়গুলো মাওলানা ইলিয়াস (রহঃ)-এর মনে গভীর দুঃখ ও উদ্বেগ সৃষ্টি করেছিল। তিনি বুঝতে পারলেন যে, উম্মতের মধ্যে ঈমানকে পুনর্জীবিত করা ছাড়া উম্মতের পরিত্রাণ সম্ভব নয়।

হতদরিদ্র শ্রমিকদের ভাড়া করে দাওয়াতের কাজে নিয়ে যাওয়া। এই পদ্ধতি ছিল অত্যন্ত ব্যতিক্রমী এবং তাৎপর্যপূর্ণ। এতে বোঝা যায় যে, মাওলানা ইলিয়াস (রহঃ) তাবলীগের কাজকে কতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন।

📌 কেন মেওয়াতে এই পদ্ধতি প্রয়োজনীয় ছিল?

মেওয়াতের মানুষরা মূলত দরিদ্র কৃষিজীবী এবং দিনমজুর ছিল। তাদের বেশিরভাগই ছিল অশিক্ষিত, দ্বীনের জ্ঞানহীন এবং দৈনন্দিন রুজির জন্য কঠোর পরিশ্রমে ব্যস্ত। অনেকেই এতটাই দরিদ্র ছিল যে, তিন দিন সময় বের করে আল্লাহর রাস্তায় বের হওয়া তাদের জন্য আর্থিকভাবে অসম্ভব ছিল।

মেও সম্প্রদায়ের মানুষদের ধর্মীয় চেতনা খুবই দুর্বল ছিল, এবং তারা হিন্দু সংস্কৃতির সাথে মিশ্রিত জীবনযাপন করতো। তাদের কাছে ঈমান, নামাজ এবং আমলের কোনো সঠিক ধারণা ছিল না। তাদের মধ্যে ইসলামি জীবনাচরণ ছিল না।

এমন অবস্থায়, মাওলানা ইলিয়াস (রহঃ) উপলব্ধি করেন যে,

“যদি আমি তাদের দাওয়াতের কাজে না নিয়ে যাই, তাহলে তারা কখনো দ্বীনের পথে আসবে না।”

📌 কীভাবে তিনি শ্রমিকদের ভাড়া করে কাজে লাগালেন?

মাওলানা ইলিয়াস (রহঃ) নিজের ব্যক্তিগত অর্থ এবং সহায়তাকারী দাতাদের অর্থ ব্যবহার করে একটি অভিনব পদ্ধতি গ্রহণ করেন।

1️⃣ শ্রমিকদের পূর্ণ পারিশ্রমিক দিয়ে নিয়োগ করা:
তিনি মেও সম্প্রদায়ের দরিদ্র মানুষদের কাছে গিয়ে বলতেন —

“তোমরা দৈনিক যেই পরিমাণ উপার্জন কর, আমি তোমাদের সেই উপার্জন পুরোপুরি দেব। কিন্তু এর বিনিময়ে তোমরা তিন দিন আল্লাহর রাস্তায় আমার সাথে বের হবে।”

এই প্রস্তাবে দরিদ্র শ্রমিকরা প্রথমে অবাক হয়ে যেত, কারণ তারা ভাবতো “আমাদের কাজ না করেও আমরা বেতন পাবো!”। আসলে তারা কখনো আল্লাহর পথে বের হওয়ার ধারণাটিই জানত না। কিন্তু মাওলানা ইলিয়াস (রহঃ) এই পদ্ধতিতে তাদের অন্তরে ইসলামের প্রতি ভালোবাসা তৈরি করতে সক্ষম হন।

2️⃣ তিন দিনের দাওয়াতের সফর:
এই তিন দিনের সফরের সময়, মেও সম্প্রদায়ের মানুষদের ইসলামের বুনিয়াদি শিক্ষা দেওয়া হতো। তারা নামাজ শিখতো, কালেমার অর্থ বুঝতো, হালাল-হারামের জ্ঞান পেতো এবং তাদের আচার-আচরণে পরিবর্তন আসতে শুরু করতো।

3️⃣ মানসিক পরিবর্তন:
মেও সম্প্রদায়ের শ্রমিকরা প্রথমে ভাড়াটে শ্রমিক হিসেবে আল্লাহর রাস্তায় বের হত, কিন্তু তিন দিনের দাওয়াত শেষে তারা নিজেরা স্বেচ্ছায় এই কাজে যুক্ত হতে চাইত। এটি ছিল মাওলানা ইলিয়াস (রহঃ)-এর সবচেয়ে বড় সফলতা। কারণ, আগে যারা টাকা পেয়ে কাজ করতো, তারা পরে স্বেচ্ছায় আল্লাহর রাস্তায় বের হতে লাগলো।

4️⃣ তাদের পরিবারে প্রভাব:
তিন দিনের সফর শেষে, যখন মেও সম্প্রদায়ের মানুষ নামাজ এবং ইসলামের গুরুত্ব সম্পর্কে জ্ঞান নিয়ে ফিরে আসতো, তখন তাদের পরিবারের লোকেরাও প্রভাবিত হতো। এভাবে পরিবার থেকে পরিবার এবং গ্রাম থেকে গ্রাম পর্যন্ত দাওয়াতের কাজ ছড়িয়ে পড়তে থাকে।

📌 কেন এই পদ্ধতি সফল হলো?

1️⃣ অর্থনৈতিক বাস্তবতা মেনে নেওয়া:
মেও সম্প্রদায় ছিল দরিদ্র এবং তাদের জন্য কাজ ছাড়া বাঁচা সম্ভব ছিল না। মাওলানা ইলিয়াস (রহঃ) তাদের অর্থনৈতিক বাস্তবতাকে সম্মান করে তাদের কাজের সমান অর্থ দিয়ে তাদেরকে আল্লাহর রাস্তায় নিয়ে যান।

2️⃣ মানসিক পরিবর্তন:
প্রথমে মেও সম্প্রদায়ের শ্রমিকরা কাজ করতে আসলেও, তিন দিন পরে তারা বুঝতে পারত,

“এই দাওয়াত তো আমার নিজের আত্মার জন্য। এটি কাজ নয়, বরং আমার আত্মিক পরিবর্তনের জন্য।”
এর ফলে ভাড়াটে শ্রমিকরা পরে স্বেচ্ছাসেবক হয়ে যেত।

3️⃣ তিন দিনের সফর মডেল:
এই তিন দিনের সফরের সময়, তারা ইসলামি শিক্ষা, নামাজ, কালেমা, দ্বীনের বুনিয়াদি শিক্ষা পেতো। তিন দিন একটি বড় মনস্তাত্ত্বিক সময়কাল, যেখানে একজন মানুষ নিজের জীবন নিয়ে চিন্তা করার সময় পায়। মাওলানা ইলিয়াস (রহঃ) এই কৌশলকে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে কাজে লাগান।

📌 এই পদ্ধতির দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব

1️⃣ মেও সম্প্রদায়ের ইসলামী পুনর্জাগরণ:
মেও সম্প্রদায়, যারা আগে হিন্দু সংস্কৃতিতে ডুবে ছিল, তারা নামাজের প্রতি সচেতন হলো, হারাম-হালালের পার্থক্য করতে শিখলো।

2️⃣ তাবলীগ জামাতের প্রসার:
মেও অঞ্চল থেকে তাবলীগ জামাত বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। আজকে বিশ্বব্যাপী ১৫০+ দেশে তাবলীগ জামাতের কার্যক্রম চলছে।

3️⃣ মানব সম্পদের উন্নয়ন:
যারা আগে শ্রমিক ছিল, তারা আজ দাওয়াতের মেহনতের কারিগর। এমন মানুষ, যারা আগে শুধুমাত্র রুটি-রুজির জন্য কাজ করত, তারা আল্লাহর জন্য সময় দিতে শিখলো।

📌 শিক্ষা ও প্রেরণা

মাওলানা ইলিয়াস (রহঃ)-এর এই উদ্যোগ আমাদের শিক্ষা দেয় যে,
• মানুষকে দাওয়াতের কাজে সম্পৃক্ত করতে হলে, তার বাস্তবতা বুঝতে হবে।
• পরিবর্তন রাতারাতি হয় না, বরং এক ধাপে এক ধাপে মানুষ পরিবর্তিত হয়।
• যে দাওয়াত আত্মার গভীরে পৌঁছায়, সেই দাওয়াতই টিকে থাকে।
• মানুষকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে দ্বীনের দিকে নিয়ে আসা কোনো অপমান নয়, বরং এটি আল্লাহর রাস্তায় দাওয়াতের উত্তম কৌশল।

🔹 মাওলানা ইলিয়াস (রহঃ)-এর প্রাথমিক শিক্ষা ও জীবন

জন্ম: মাওলানা ইলিয়াস (রহঃ) ১৮৮৫ সালে উত্তর প্রদেশের কান্ধলায় এক ধার্মিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
শিক্ষা: তিনি দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে ইসলামী শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং আলেম এবং মুফতিদের সরাসরি সংস্পর্শে আসেন। দেওবন্দের বিখ্যাত মুরব্বি মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী (রহঃ), মাওলানা কাসেম নানুতুবী (রহঃ) এবং মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহঃ) এর সান্নিধ্য পান।

তার শিক্ষকরা শুধু ফিকহ-তাফসীর শিক্ষা দেননি, বরং তাকে দ্বীনের দাওয়াত এবং আমলের জন্য আত্মত্যাগের শিক্ষা দিয়েছিলেন। পরে তিনি নিজের জীবনের মিশন হিসেবে এই কাজকে গ্রহণ করেন।

🔹 তাবলীগ মেহনতের সূচনা (১৯২৭)

মেওয়াত অঞ্চল পরিদর্শন:
দাওয়াত ও তাবলীগের চিন্তা শুরু হয় যখন মাওলানা ইলিয়াস (রহঃ) মেওয়াত পরিদর্শন করেন। সেখানে গিয়ে তিনি দেখলেন, মেও সম্প্রদায়ের মুসলমানরা নামাজ পড়েন না, ইসলামি শিক্ষা ভুলে গেছেন, হারাম-হালালের মধ্যে পার্থক্য করেন না। তারা এমন সব কাজ করতো যা ইসলামের বিধানের সাথে সাংঘর্ষিক।

এমন পরিস্থিতি দেখে তিনি গভীরভাবে ব্যথিত হন এবং আল্লাহর কাছে দোয়া করেন:
“হে আল্লাহ! তুমি আমার জীবন নিয়ে নাও, কিন্তু আমাকে এমন কাজের জন্য কবুল করো, যাতে উম্মতের ঈমান ও আমল মজবুত হয়।”

পরিকল্পনা ও কৌশল:
মাওলানা ইলিয়াস (রহঃ) বুঝতে পারলেন যে, মানুষের মধ্যে দাওয়াত ও দ্বীনের মেহনত পুনরায় চালু না করলে এদের ফেরানো সম্ভব নয়। তখন তিনি প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা পরিবর্তন করার জন্য নতুন কৌশল নিলেন। সাধারণ আলেমদের মতো শুধু মসজিদে বসে শিক্ষা দেওয়ার বদলে, তিনি মানুষকে সরাসরি দ্বীনের দাওয়াত দেওয়ার জন্য বাইরে বের হওয়ার পরিকল্পনা করলেন। এই উদ্যোগই তাবলীগ জামাতের মূলনীতি।

🔹 তাবলীগের মূলনীতি ও কর্মপদ্ধতি

মাওলানা ইলিয়াস (রহঃ) তাবলীগের জন্য কিছু মৌলিক নীতি স্থাপন করেন, যা আজও তাবলীগ জামাতের মূল কাঠামো। এই নীতিগুলো হলো:
1️⃣ ইখলাস (শুধু আল্লাহর জন্য কাজ)
2️⃣ শূরা (পরামর্শ ভিত্তিক সিদ্ধান্ত)
3️⃣ জিম্মাদারির ভিত্তিতে কাজ
4️⃣ নিজেদের চরিত্র গঠন ও ঈমানকে মজবুত করা
5️⃣ দাওয়াত (মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বান করা)
6️⃣ হালাল-হারাম বিষয়ে সচেতনতা

🔹 ৬টি মূল শিক্ষা

মাওলানা ইলিয়াস (রহঃ) ৬টি মূল শিক্ষা প্রদান করেন, যা তাবলীগ জামাতের মূল দাওয়াতি কাজের ভিত্তি:
1️⃣ কালেমা – লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ
2️⃣ নামাজ – নামাজকে শুদ্ধভাবে আদায় করা
3️⃣ ইলম ও জিকির – ইসলামি জ্ঞান অর্জন ও আল্লাহকে স্মরণ করা
4️⃣ ইকরামুল মুসলিমিন – সকল মুসলিমের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা
5️⃣ ইখলাস – কাজকে একমাত্র আল্লাহর জন্য করা
6️⃣ তাফরিগে ওয়াক্ত – আল্লাহর রাস্তায় সময় ব্যয় করা

🔹 দাওয়াতের কৌশল ও তিন দিনের সফর

মাওলানা ইলিয়াস (রহঃ) দেখলেন, মানুষের ঈমান জাগ্রত করার জন্য মসজিদে দাওয়াত দেওয়া যথেষ্ট নয়। এজন্য তিনি ঘোষণা করেন, মানুষকে দাওয়াত দেওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। যারা তাবলীগে আসবে, তাদের ৩ দিন, ৪০ দিন, ৪ মাস বা ১ বছর সময় বের করে আল্লাহর রাস্তায় বের হতে হবে। এর মাধ্যমে মানুষ নিজের ঈমান এবং আমলকে মজবুত করবে।

🔹 দাওয়াতের ফলাফল

এই দাওয়াতের ফলে মেওয়াতের পরিস্থিতি একেবারে পাল্টে যায়।
• মেও সম্প্রদায়ের মানুষ নামাজ পড়তে শুরু করে।
• শুধু মেও নয়, পুরো বিশ্বজুড়ে দাওয়াতের কাজ শুরু হয়।
• শত শত মানুষ ইসলামের দিকে ফিরে আসে।
• তাবলীগ জামাত আন্তর্জাতিক আন্দোলনে পরিণত হয়।

🔹 মাওলানা ইলিয়াস (রহঃ)-এর ইন্তেকাল

১৯৪৪ সালে মাওলানা ইলিয়াস (রহঃ) ইন্তেকাল করেন। তার ইন্তেকালের পর মাওলানা ইউসুফ (রহঃ) নেতৃত্ব গ্রহণ করেন এবং তাবলীগ জামাত আরও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।

🔹 তাবলীগের বর্তমান অবস্থা

আজ বিশ্বব্যাপী ১৫০টির বেশি দেশে তাবলীগের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। বিশ্ব ইজতেমা হলো তাবলীগ জামাতের সবচেয়ে বড় জমায়েত, যেখানে বিশ্বের লাখো মানুষ অংশগ্রহণ করে।

🔹 উপসংহার

মাওলানা ইলিয়াস (রহঃ) এর দাওয়াতি মেহনত আজ বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমানের ঈমান ও আমলকে জাগিয়ে তুলেছে। তার পরিশ্রম, ধৈর্য এবং ত্যাগ তাবলীগ জামাতকে বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম ইসলামী আন্দোলনে পরিণত করেছে।

তাবলীগ জামাত শুধুমাত্র দাওয়াত নয়, এটি ঈমান, আমল, ত্যাগ এবং ঐক্যের মেহনত।
মাওলানা ইলিয়াস (রহঃ) বলেছেন:

“আমার দাওয়াতের উদ্দেশ্য, মানুষ নিজের ঈমানকে শক্তিশালী করবে এবং আল্লাহর রাস্তায় কাজ করবে।”

আল্লাহ আমাদেরকে তাবলীগ জামাতের মূল উদ্দেশ্য বুঝে কাজ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : মোহাম্মাদ মুজিবুল হক (তুষার)

তাবলীগইতিহাস #মাওলানাইলিয়াস #ঈমানআমল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *